রথযাত্রা দিনটা প্রত্যেকের কাছে খুবই স্মৃতিময়। বিশেষ করে যারা ছোটবেলায় বিকেল হলেই জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা সমেত নিজের ছোট্ট দোতলা তিনতলা রথ নিয়ে বাবার হাতটা ধরে বেরিয়ে পরত। আর তার সঙ্গে তো রয়েছে পাঁপড় ভাজা আর ভেঁপু বাঁশি। সকালে স্কুল থেকে হাফ ছুটি পেয়ে বাড়ি এসে কোনরকমে ব্যাগ রেখে জামা কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে রথ সাজানোর মজাই ছিল আলাদা। সারাদুপুর চলত রথ সাজানোর কাজ। তার যেন আনন্দই ছিল অন্যরকম। কিন্তু নিজের কতক্ষণই বা রথ টানা হত, বড় রথ দেখার উৎসাহ আনন্দ কি কম ছিল?
সব মিলিয়ে রথ মানেই হল হাফ ছুটি মেলা খাওয়া-দাওয়া অফুরন্ত মজা। রথযাত্রা বলতে আমরা পুরী রথযাত্রা কে শ্রেষ্ঠ বলে ধরি। কিন্তু কলকাতার অলিতে গলিতে এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু বের হয় যেগুলো দেখলে আপনি চোখ ফেরাতে পারবেন না এবং তার যাত্রা হয় দেখার মতো।
কলকাতার বিখ্যাত রথযাত্রা-
রানী রাসমণির বাড়ির রথ:
রাসমণি দাস এর শ্বশুর বাড়িতে প্রতিষ্ঠা দেবতা ছিলেন রঘুবীর। এক রাতে রঘুবীর রানীকে স্বপ্ন দেন এবং রথে চড়ার আবদার করেন। দয়াময়ী করুণাময়ী রানী রাসমণি কারুর আবদার ফেরাতেন না, তাহলে তাঁর আরাধ্য দেবতা আবদার কিভাবে ফেরাবেন? যেমন ভাবা তেমন কাজ তিনি তার ছোট জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস কে নিয়ে ব্রিটিশ হ্যামিল্টন কোম্পানির খাঁটি রুপো দিয়ে রথ তৈরি করেন এবং সেই রথে রঘুবীর কে বসিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন গোটা পরিবার। তখনকার দিনে এই রদ বানাতে খরচ হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।
হাতিবাগানের মাধব বাড়ী রথ:
হাতিবাগানের মাধব বাড়ীর রথ আজও শোভাযাত্রা করে পাড়ি দেয় বেলগাছিয়ায়। ওখানেই রাধামাধব মন্দিরে সাতদিন থাকেন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা। মাধব বাড়িতে ঢোকার রাস্তা খুবই ছোট, কিন্তু এই মার্বেলের মন্দির দেখলে চোখ একেবারে তা দিয়ে যাবে এই রথের শোভাযাত্রা দেখার জন্য অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান রাস্তায়।
প্রামানিক বাড়ীর রথ:
তারক প্রামানিক রোডের প্রামানিক বাড়ীর রথ পুরোটা ব্রোঞ্জের তৈরি। ব্রিটিশ কায়দায় তৈরি হয়েছে এই রথ, রথের চার দন্ড রয়েছে চারমূর্তি ইউরোপিয়ান গাউন পরা। এই রথ কোন দিন বাড়ির বাইরে টানা হয়নি। শ্রীধর জীউয়ের বিগ্রহ বসিয়ে টানা হয় রথটি।
পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত রথযাত্রা-
মাহেশের রথযাত্রা, শ্রীরামপুর :
Rathayatra of Mahesh) ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব। এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পশ্চিমবঙ্গেরশ্রীরামপুর শহরের মাহেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। রথযাত্রার সময় মাহেশের স্নানপিড়ি ময়দানে এক মাস ধরে মেলা চলে। শ্রীরামপুরের মাহেশ জগন্নাথ দেবের মূল মন্দির থেকে মাহেশ গুন্ডিচা মন্দির (মাসীরবাড়ী) অবধি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার ৫০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। উল্টোরথের দিন আবার রথটিকে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা উৎসবের পিছনে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি হল: চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তিনি তা করতে পারলেন না। তখন দুঃখিত হয়ে তিনি আমরণ অনশনে বসলেন। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, “ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামেতে এক গ্রাম আছে। সেখানে যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) পাঠিয়ে দেবো। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পূজা করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।” এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তারপর এক বর্ষার দিনে মাহেশ ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এল। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।
পরবর্তীকালে ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন যা আজও রয়েছে। বর্তমান রথটি প্রায় ১২৯ বছরের পুরনো। সে যুগে ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। রথটিতে রয়েছে মোট ১২টি লোহার চাকা এবং দু’টি তামার ঘোড়া। ইতিহাস বলে সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী স্বপ্ন পেয়ে গঙ্গায় ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে দারুমূর্তি তৈরি করেন। প্রতি বছর রথের আগে বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়ে থাকে। রথের দিন জিটি রোড দিয়েই রথ টানা হয়। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও বসে মেলা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘রাধারানি‘ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।
গুপ্তিপাড়ার রথ:
হুগলির গুপ্তিপাড়া রথযাত্রা হল পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত রথযাত্রা গুলির মধ্যে একটি। পুরি রথ কে যেমন জগন্নাথ দেবের রথ বলা হয় গুপ্তিপাড়ার রথ কে বলা হয় বৃন্দাবন জীউর রথ। এই রথের ষোলটি চাকা এবং উচ্চতা হলে ৩৬ ফুট।
আমোদপুর এর রথযাত্রা:
আমোদপুর হল বর্ধমানের মেমারি অঞ্চলের ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামের জমিদার পরিবারের দেবতা হলেন রাধামাধব। গ্রামের জমিদার পরিবার প্রতিবছর ধুমধাম করে রথ যাত্রার আয়োজন করেন। রথযাত্রার দিন সকালবেলা প্রথমে রথে চড়ে দেবদেবী কোন দুর্গাবাড়ি যান তারপর সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন।
লালগোলা রাজবাড়ী রথযাত্রা:
মুর্শিদাবাদের সীমান্ত শহর লালগোলা রাজবাড়ী টি আঠারোশো খ্রিস্টাব্দে তৈরি করেছিলেন রাজারাম শঙ্কর রাও। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে রাজকীয় পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি স্থাপন করেছিলেন বিষ্ণু, রঘুবীর, কালী ,জগদ্ধাত্রী ,লক্ষী সহ নানা দেব দেবীর মন্দির। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো মুর্শিদাবাদ জেলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বৈষ্ণব ও শাক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।তাঁর পুত্র রাজা মহেশ নারায়ণ ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে ছ’চাকা বিশিষ্ট পিতলের একটি রথ তৈরি করান, আজও সেটিই পথে বেরয়।থের দিন রাজ পরিবারের কুলদেবতা চক্রধর শিলার মাথায় ছাতা ধরে রথটিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করিয়ে তাঁকে রথে তোলা হয়। পরে মন্দির থেকে খানিকটা পথ দূরে নাটমন্দিরের রথতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথামতো এক সপ্তাহ পরে আবার চক্রধর শিলা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাজবাড়িতে।মুর্শিদাবাদের নশিপুরের রাজা দেবী সিংহের রাজ পরিবারের রুপোর রথ আজও পর্যটকদের দর্শনীয় সামগ্রী। এছাড়া কাশিমবাজারের নন্দী পরিবারের বড় রাজবাড়ি এবং আশুতোষ রাইদের ছোট রাজবাড়ির রথযাত্রা উৎসব আজও বহু মানুষ প্রত্যক্ষ করতে যান।