১৯০২ সালের ৪ জুলাই আজকের দিনেই মৃত্যু হয় স্বামী বিবেকানন্দের। তাঁর নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হলেও চিরকালীন হল তাঁর অমর বাণী।আজ মহামানব স্বামী বিবেকানন্দের ১১৯ তম মহাসমাধি দিবস। তার চিন্তাধারা ,আদর্শ আজও বাঙালি তথা সমস্ত বিশ্ববাসীকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি একজন দার্শনিক ছাড়াও ছিলেন লেখক ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর লেখা প্রত্যেকটা বই আজও সকল বাঙালী তথা সমগ্র দেশবাসীকে সমানভাবে মুগ্ধ করে চলেছে।
‘বিড়ম্বনা’ তার আজীবনের সঙ্গী ছিল। প্রতি পদে পদে বাধা, সারা জীবন বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা সমালোচিত এবং নিন্দিতও হয়েছেন। তবুও শুধু অদম্য মনোবল আর জেদের বশবর্তী হয়ে একটার পর একটা বাধা অতিক্রম করে গেছেন তিনি।
আলমবাজার বা বরানগর মঠে থাকার সময়ে খালি মেঝেতে শয়ন করতেন, বালিশের পরিবর্তে মাথার নীচে একখন্ড থান ইট। নুন আর একমুঠো ভাত তাও কোনক্রমে একবেলা জুটত;এমনকি প্রতিবেশীদের বাড়িতে কলাপাতা কাটতে গেলে“মঠের নামে যত সব বখাটে ছেলেদের আড্ডা” বলে তাড়া করে আসতেন প্রতিবেশীরা। তাই ভাত খেতেন কলাপাতার পরিবর্তে মানকচু পাতায়। কি ভীষন ত্যাগ! অথচ খেতে এবং খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন। মশলাদার মাছ মাংসের বিভিন্ন পদ ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁই শাক ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় খাবার। নিজে খুব ভালো রান্না করতেও পারতেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিশাল অংশ পরিভ্রমন করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন মনীষীদের রচনা, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য এবং ভারত ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, ভারতে তাঁর পূর্ব পুরুষগণের সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্রের শত বছরের যুক্তি নির্ভর সংস্কার প্রচেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি। তখনি তিনি ফিরে গেলেন ভারতীয়দের প্রাচীন পন্থা, ধর্ম পথে। তিনি দেখতে পেলেন ধর্মের মাধ্যমেই মানুষকে পরিশুদ্ধ করা সম্ভব। আর এরই লক্ষ্যে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে, যেখানে অন্যধর্মের লোকেরা নিজেদের ধর্মের স্তুতি বর্ণনে ব্যস্ত, সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গুরু ‘শ্রীরাম কৃষ্ণ পরমহংস দেবের মহান বানী ‘যত মত তত পথ’, বিশ্বের সকল ধর্মের অনুগামীদের সম্মুখে উপস্থিত করলেন।
স্বামীজীর চিন্তা ধারা ছিল একদম অন্যরকম :
যেমন একদিনের ঘটনা, একটি বিদেশী মেয়ে এসে স্বামীজীকে বললেন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
স্বামীজী বললেন, কেন? আমি তো ব্রহ্মচারী।
মেয়েটি বলল, আমি আপনার মত পুত্র চাই যে সারা পৃথিবীতে আমার মুখ উজ্জল করবে।এবং সেটা একমাত্র আপনাকে বিয়ে করলেই সম্ভব।
স্বামীজী বললেন,আমি যদি এর অন্য উপায় বলি?
মেয়েটি বলল, কি?
স্বামীজী বলল, আপনি আমাকে আপনার পুত্র করে নিন। আমি আপনাকে মা ডাকব।এতে আপনার মন বাসনাও পূর্ন হবে আর আমার ব্রহ্মাচার্যও অটুট থাকবে!!
১৮৯৩ সালে শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তাঁর পেশ করা বক্তব্য আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সেখানেই দুনিয়া শুনেছিল তাঁর বিখ্যাত উক্তি — ‘মাই ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স অফ আমেরিকা।’ আজও তাঁর বাণী প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।বিজ্ঞান ও ধর্মের বিষয়ে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। পাশ্চাত্য দেশকে তিনি দেখিয়েছিলেন, কীভাবে এই দুই বিষয়ের সহাবস্থান সম্ভব। বিড়াম্বনা স্বামীজীকে তাঁর মৃত্যুর পরেও ছাড়েনি।
শুক্রবার, ২৮শে মার্চ ১৯০২, দেহত্যাগের কিছুদিন আগে নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি এখন আমাকে যেতেই হবে।” মঙ্গলবার, ১লা জুলাই ১৯০২, মঠের মাঠে ভ্রমণ করতে করতে গঙ্গার ধারে একটা জায়গা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে স্বামীজি গম্ভীর ভাবে বলেছিলেন,”আমার নশ্বর দেহ গেলে ঐখানে সৎকার করবি।” আর ৪ঠা জুলাই শুক্রবার রাত্রি ৯টা নাগাদ স্বামীজির আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন।তাঁর শেষ ইচ্ছা মত বেলুর মঠের এক প্রান্তে তাঁর নশ্বর দেহের সৎকারের ব্যবস্থা করতেই, স্থানীয় লোকেদের আপত্তিতে সৎকার বন্ধ হয়ে যায়।স্থানীয় লোকেদের দাবিতে সৎকার শ্মশানেই করতে হবে একথা জানিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি সৎকার আটকে দেয়। পরে অনেক চেষ্টা করে পুরসভার সম্মতি আদায় করা হয়। এখানেই বিড়ম্বনা শেষ নয় স্বামীজি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন না বলে এক ব্রাহ্মণ বিচারপতি বলেছিলেন,দেশে হিন্দু রাজার শাসন থাকলে স্বামীজিকে ফাঁসি দেওয়া হত। কারণ শাস্ত্রমতে একজন শুদ্রের সন্ন্যাস গ্রহণের অধিকার নেই।
আর আজীবন এত বিড়াম্বনার মধ্যেও তিনি ছিলেন তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল আর সেই কারণেই তো তিনি কোটি কোটি বিশ্ববাসীর মনের মনি কোঠায় এখনো বিরাজমান।