অর্পিতা লাহিড়ী
বাড়ি থেকে যখন পালিয়ে যান তখন তার বয়স মাত্র পনের বছর। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি তখন মিলিয়নিয়ার। বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রতারক। যাঁর বায়োপিক হয়েছে হলিউডে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন স্বয়ং লিওনার্দো ক্যাপ্রিও। যে প্রতারকের কথা আজ বলতে বসেছি তিনি তাঁর প্রতারক জীবনে কি ভূমিকা পালন করেননি! ডাক্তার, পাইলট, আইনজীবী, কলেজের অধ্যাপক এমনকি মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এজেন্ট হিসেবেও তাঁকে দেখা গিয়েছে। কি জানতে ইচ্ছে করছে তো, কি নাম এই বহুমুখী প্রতিভাবান প্রতারকটির। তিনি হলেন ফ্র্যাঙ্ক অ্যাবাগনেল। আ্যবাগানেলের বায়োপিক বানালেন স্বয়ং স্টিফেন স্পিলবার্গ।
আসুন একটু দেখে নেওয়া যাক কেমন ছিল ফ্র্যাঙ্কের ছোটবেলা, কোথায় জন্মেছেন তিনি, কেনই বা স্পিলবার্গ এমন একজন বিশ্ববন্দিত প্রতারকের চরিত্র বাছলেন বায়োপিকের জন্য।
ফ্র্যাঙ্ক উইলিয়াম অ্যাবাগনেল জুনিয়রের জন্ম ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তার বয়স যখন ১২ বছর, তখন তার বাবা-মা পৃথকভাবে থাকতে শুরু করেন। যদিও তাদের পরিবার মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল, তবুও সে সময় থেকেই ফ্র্যাঙ্ক দোকান থেকে টুকিটাকি জিনিস চুরি করতে শুরু করেন। কিন্তু প্রথম বড় আকারের প্রতারণার ঘটনাটি তিনি ঘটান তার বাবার সঙ্গেই, মাত্র ১৫ বছর বয়সে।
ফ্র্যাঙ্কের বাবার একটি ক্রেডিট কার্ড ছিল, যেটি তিনি মাঝেমধ্যে ছেলেকে ব্যবহার করতে দিতেন। সেই কার্ড জালিয়াতি করে ফ্র্যাঙ্কের প্রতারণায় হাত পাকানো শুরু। কার্ড ব্যবহার করে তিনি গাড়ির যন্ত্রাংশ, ব্যাটারি এসব কিনতেন। তারপর তা বেচে দিতেন খোলা বাজারে। হাতে আসত কড়কড়ে ডলার।
ফ্র্যাঙ্কের এই প্রতারণা যখন ধরা পড়ে ততদিনে তিনি বাবার কার্ড থেকে ৩,৪০০ ডলার খরচ করে ফেলেছেন, বর্তমান হিসেবে যার মূল্যমান প্রায় ২৮,০০০ ডলার। ফ্র্যাঙ্কের মা ছেলেকে সংশোধনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন বোর্ডিং স্কুলে। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কের ১৬ বছর বয়সের সময় তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেলে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং ঘণ্টায় ১.৫ ডলারের বিনিময়ে কাজ করতে শুরু করেন। ফ্র্যাঙ্কের বিশ্বাস ছিল, তার বয়স কম বলেই তাকে কম মজুরি দেওয়া হচ্ছিল। ফলে ড্রাইভিং লাইসেন্স জালিয়াতি করে নিজের জন্মতারিখ ১০ বছর পিছিয়ে দিয়ে তিনি নিজেকে ২৬ বছর বয়সী পরিচয় দিয়ে বেশি মজুরি অর্জন করতে শুরু করেন।
মানুষের আস্থা অর্জনের অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ফ্র্যাঙ্কের।ফ্র্যাঙ্ক জালিয়াতির নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন করতে শুরু করেন। প্রথমে তিনি একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে সেগুলো থেকে চেক দিয়ে অতিরিক্ত টাকা তুলতে শুরু করেন। এরপর তিনি অন্যান্য কাস্টমারদেরদের অসাবধানতাকে পুঁজি করে তাদের চেকে নিজের অ্যাকাউন্ট নম্বর বসিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি নিজেই জাল চেক তৈরি করা আয়ত্ত করতে থাকেন। তার নিজের হিসেবেই চেক জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি মোট ২.৫ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছিলেন।
○এক পাইলটের পরিচয় পত্র কে জালিয়াতি করেন ফ্র্যাঙ্ক।প্যান অ্যাম এয়ারলাইন্সের এক পাইলটের আইডি এবং লাইসেন্স জাল করেন। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে ফোন করে দাবি করেন, তিনি তাদের একজন পাইলট, কিন্তু হোটেলে থাকার সময় তার ইউনিফর্মটি হারিয়ে গেছে। আশ্চর্য হলেও সত্যি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেন সেই কথা। পাঠিয়ে দেন ইউনিফর্ম।
সেই সময় মার্কিন মুলুকের পাইলটরা যেকোনো প্লেনে যাত্রী হিসেবে বিনা খরচে ফ্লাই করতে পারতেন এবং যেকোনো হোটেলে বিনা খরচে থাকতে পারত। এই নিয়মের সুযোগ নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক দুই বছরের মধ্যে ২৫০টি ফ্লাইটে করে সর্বমোট ১৬ লক্ষ কিলোমিটার আকাশপথ ভ্রমণ করেন। নিজের ওপর থেকে সন্দেহ এড়ানোর জন্য ফ্র্যাঙ্ক নাকি বেশ কিছু সুন্দরী স্টুয়ার্ট দের নিয়োগ করেন। একবার যাত্রী সেজে ভ্রমণ করতে থাকা এই জালিয়াতকে পাইলটরা বিমান চালনার পরামর্শ দেন। বিপাকে পড়া ফ্রাঙ্ক বিমানটিকে অটো পাইলট মোডে দিয়ে কোনমতে সে যাত্রায় নিস্তার পান।
ফ্র্যাঙ্ক অ্যাবাগনেল তার প্রতারক জীবনের ৫ বছর সময়ের মধ্যে মোট আটটি ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করেছেন। এরমধ্যে তিনি ফ্র্যাঙ্ক অ্যাডামস ছদ্মনামের অধীনে বার্মিংহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এক সেমিস্টার শিক্ষকতাও করেছেন। চাকরিটি পাওয়ার জন্য তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার সার্টিফিকেট জাল করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তার সুন্দর ব্যবহার এবং দক্ষতা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
বাড়ি থেকে পালানোর মাত্র ৬ বছরের মাথায়, ১৯৬৯ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে যাবতীয় অ্যাডভেঞ্চার শেষে এফবিআইর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ফ্র্যাঙ্ক অ্যাবাগনেল আমেরিকা ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান। কিন্তু ততদিনে আমেরিকা ছাড়াও বিশ্বের ২৬টি দেশে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তার এক প্রাক্তন প্রেমিকা যখন তাকে তাকে চিনে ফেলে, তখন ওয়ান্টেড পোস্টারের সাথে তার মিল খুঁজে পেয়ে পুলিশে খবর দিয়ে তাকে ধরিয়ে দেয়।
ফ্রান্স এবং সুইডেনে পর্যায় ক্রমে জেলখাটার পর তাঁকে আমেরিকার হাতে প্রত্যাপন করা হয়। তবে ধুরন্ধর এই প্রতারক এফবিআইয়ের দুঁদে গোয়েন্দাদেরও তার প্রতারণা দিয়ে ঘোল খাইয়েছিলেন।
তবে ১২ বছরের কারাদন্ড হলেও ফ্র্যাঙ্ক অ্যাবাগনেলকে জেল খাটতে হয়েছিল মাত্র ৪ বছর। তিনি ছিলেন তার সময়ের বিশ্বের অন্যতম সেরা চেক জালিয়াত এবং প্রতারক। ফলে এফবিআই তার এই মেধাকে অন্যান্য অপরাধীদেরকে ধরার কাজে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৪ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এই শর্তে যে, তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার করে হাজিরা দেবেন এবং এফবিআইকে তার অভিজ্ঞতার আলোকে জাল চেক শনাক্তকরণে এবং প্রতারক ও জালিয়াতদেরকে গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে পরামর্শ দেবেন।
আজও এফবিআইয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক ফ্র্যাঙ্ক আ্যবগানেলের। তবে প্রতারণার জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি এই মার্কিনি ছেড়ে এসেছেন প্রতারণার অন্ধকার জগৎ। বরং বিপুল অভিজ্ঞতার আলোকে মার্কিন গোয়েন্দাদের সহযোগিতা করে চলেছেন প্রতারণার সুলুকসন্ধান পেতে। লিখেছেন বেশ কয়েকটি বই। একেই বোধহয় বলে দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকীতে উত্তরণ। আর তাঁর জীবন নিয়ে প্রস্তুত হওয়া বায়োপিকের নাম Catch Me If You Can।