লক্ষ্মীর পাঁচালী
দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ।
ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস ।।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।
করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন ||
সেইকালে বীণা হস্তে নারদ মুনিবর।
লক্ষ্মী নারায়ণে নমি কহিল বিস্তর।
ঋষি বলে মাগাে তব কেমন বিচার।
সর্বদা চঞ্চলা হয়ে ফির দ্বারে দ্বার ৷
মর্ত্যবাসী সদা তাই ভুগিছে দুর্গতি।
ক্ষণেকের তরে তব নাহি কোথা স্থিতি।
প্রতিদিন অন্নভাবে সবে দুঃখ পায়।
প্রতি গৃহে অনশন জীর্ণ-শীর্ণকায় ॥
নারদের বাক্য শুনি লক্ষ্মী ঠাকুরাণী।।
সঘনে নিঃশ্বাস ত্যজি কহে মৃদুবাণী ।।
বৃহস্পতিবারে মিলি যত এয়ােগণে।
বাড়িবে ঐশ্বৰ্য্য তাহে তােমার কৃপায়।
দুঃখ কষ্ট দূরে যাবে তােমার দয়ায় ॥
শ্রীহরির বাক্য শুনি আনন্দিত মনে।
মর্তে চলিলেন লক্ষ্মী ব্রত প্রচারণে।
অবন্তী নগরে লক্ষ্মী হ’ল উপনীত।
দেখিয়া শুনিয়া হ’ল বড়ই স্তম্ভিত।
নগরের লক্ষপতি ধনেশ্বর রায়।
অগাধ ঐশ্বৰ্য্য তার কুবেরের প্রায়।
সােনার সংসার তার শূন্য হিংসা দ্বেষ ।
প্রজাগণে পালিত সে পুত্র নির্বিশেষে ॥
যথাকালে সসম্মানে গেল লােকান্তর ।।
কভুনা কাহার প্রতি আমি করি রােষ।
পিতার মৃত্যুর পর সপ্ত সহােদর।
হইল পৃথক অন্ন সপ্ত সহােদর ||
নরনারী দুঃখ পায় নিজ কর্মদোষ ॥
যাও তুমি ঋষির ত্রিলােক ভ্রমণে।
ইহার বিধান আমি করিব যতনে ॥
অতঃপর চিন্তি লক্ষ্মী নারায়ণে কয়।।
কিরূপে হরিব দুঃখ কই দয়াময় ।
হরি কহে শুন সতী বচন আমার।
মর্ত্যধামে লক্ষ্মী ব্রত করহ প্রচার ।।।
বৃহস্পতিবারে মিলি যত এয়ােগণে।
সন্ধ্যাবেলা পূজার কথা শুনি ভক্তিমনে।
বাড়িবে ঐশ্বর্যা তাহে তােমার কৃপায়।।
দুঃখ কষ্ট দূরে যাবে তােমার দয়ায় ||
শ্রীহরির বাক্য শুনি আনন্দিত মনে।
মর্তে চলিলেন লক্ষ্মী ব্রত প্রচারণে ॥
অবন্তী নগরে লক্ষ্মী হ’ল উপনীত।
দেখিয়া শুনিয়া হ’ল বড়ই স্তম্ভিত।
নগরের লক্ষপতি ধনেশ্বর রায়।
অগাধ ঐশ্বর্য তার কুবেরের প্রায়।
সােনার সংসার তার শূন্য হিংসা দ্বেষ।
প্রজাগণে পালিত সে পুত্র নির্বিশেষে ৷
এক অন্নে সাত পুত্র রাখি ধনেশ্বর।
যথাকালে সসম্মানে গেল লােকান্তর ||
পিতার মৃত্যুর পর সপ্ত সহােদর।
হইল পৃথক অন্ন সপ্ত সহােদর ।
ক্রমে ক্রমে লক্ষ্মীদেবী ছাড়িল সবারে।
সােনার সংসার সব গেল ছারখারে।
বৃদ্ধা ধনেশ্বর পত্নী না পারি তিষ্ঠিতে।
গহণ কাননে যায় জীবন ত্যজিতে।
হেনকালে ছদ্মবেশে দেবী নারায়ণী।
বন মাঝে উপনীত হলেন আপনি।
মধুর বচনে দেবী জিজ্ঞাসে বৃদ্ধারে।
কিজন্য এসেছ তুমি গহণ কান্তারে ।
কাঁদিতে কাদিতে বৃদ্ধা অতি দুঃখভরে।
তাহার ভাগ্যের কথা বলিল লক্ষ্মীরে।
সহিতে না পারি আর সংসার যাতনা।
ব্রতকথা শুনি তার ভক্তি উপজিল।
ত্যজিব জীবন আমি করেছি বাসনা ।
লক্ষ্মীদেবী বলে শুন আমার বচন।
মহাপাপ আত্মহত্যা নরকে গমন।
আমি বলি সাধবী তুমি কর লক্ষ্মীব্রত।
দুঃখ রবি অস্ত যাবে হবে পূবমত।
মনেতে লক্ষ্মীর মূর্তি করিয়া চিন্তন।
একমনে ব্রতকথা করিবে শ্রবণ ।
ঘরে গিয়ে এয়াে লয়ে কর লক্ষ্মীব্রত।
যেই গৃহে লক্ষ্মীব্রত গুরুবারে হয়।
বাঁধা থকে লক্ষ্মী তথা জানিও নিশ্চয় ।
বলিতে বলিতে দেবী নিজ মূর্তি ধরি।
দরশন দিল তারে লক্ষ্মী কৃপা করি ।
মূর্তি হেরি বৃদ্ধা তারে প্রণাম করিল।
আনন্দিত হয়ে বৃদ্ধা গৃহেতে ফিরিল ৷
গৃহেতে ফিরিয়া বৃদ্ধা করিল বর্ণন।
যেরূপে ঘটিল তার দেবী দরশন।
ব্রতের বিধান সব বধূদের বলে ।
শুনি বধুগণ ব্রত করে কৌতূহলে ॥
বধূগণ লয়ে বৃদ্ধা করে লক্ষ্মীব্রত।
হিংসা দ্বেষ-স্বার্থ ভাব হৈল তিরােহিত।
মা লক্ষ্মী করিল তথা পুনরাগমন।
অচিরে হইল গৃহ শান্তি নিকেতন।
দৈবযােগে একদিন বৃদ্ধার আলয়ে।
উপনীত এক নারী ব্রতের সময়ে ||
ব্রতকথা শুনি তার ভক্তি উপজিল ।
লক্ষ্মীব্রত করিবারে মানস করিল ৷
স্বামী তার চিররুগ্ন অক্ষম অর্জনে।
ভিক্ষা করি যাহা পায় খায় দুইজনে।
এই কথা চিন্তি নারী করিছে কামনা।
নিরােগ স্বামীরে কর চরণে বাসনা ॥
ঘরে গিয়ে এয়ো লয়ে করো লক্ষ্মীব্রত ।
ভক্তিসহ সাধবী নারী পুজে বিধিমত ৷৷
দেবীর কৃপায় তার দুঃখ হলাে দূর।
পতি হলাে সুস্থ দেহ ঐশ্বৰ্য্য প্রচুর ॥
কালক্রমে শুভদিনে জন্মিল তনয়।
সংসার হইল তার সুখের আলয় ।
দয়াময়ী লক্ষ্মীমাতা সদয় হইল।
রূপবান পুত্র এক তাহার জন্মিল ||
এইরূপে লক্ষ্মীব্রত করে ঘরে ঘরে।
প্রচারিত হলো ক্রমে অবন্তী নগরে।।
শুন শুন এয়ােগণ এক অপূর্ব ব্যাপার
ব্রতের মাহাত্ম হ’ল যে ভাবে প্রচার ।
অবন্তী নগরে এক গৃহস্থ ভবনে।
এয়ােগণ লক্ষ্মীব্রত করে একমনে ||
সহসা সেখানে এলাে বণিক তনয়।
উপনীত হলাে তথা ব্রতের সময় ।
ধনরত্ন আদি করি ভাই পঞ্চজন।
পরস্পর অনুগত রয় সবর্জন ।
ব্রত দেখি হেলা করি সাধুর তনয়।
বলে একি ব্রত, ইথে কিবা ফলােদায় ॥
সদাগর বাক্য শুনি বলে বামাগণ।
করি লক্ষ্মীব্রত যাতে কামনা পূরণ ॥
পুনরায় কৃপা দৃষ্টি দেন সদাগরে |
এই ব্রত যে করিবে ধনে জনে তার।
লক্ষ্মী বরে হবে তার সােনার সংসার
শুনি তাহা সদাগর বলে অহঙ্কারে
যে জন অভাবে থাকে সে পূজে উহারে ॥
সাধুর সংসার হলাে পূর্বের মতন।
ধনৈশ্বৰ্য ভােগ আদি যা কিছু সম্ভবে।
সবই তাে আমার আছে আর কিবা হবে৷৷
ভাগ্যে না থাকিলে লক্ষ্মী কিবা দিবে ধন।
হেন কথা কভু আমি না শুনি কখন।
অহঙ্কার বাক্য লক্ষ্মী সহিতে না পারে।
গর্বের কারণে লক্ষ্মী ছাড়িল তাহারে ||
অহঙ্কার বাক্য লক্ষ্মী সহিতে না পারে
গর্বের কারণে লক্ষ্মী ছাড়িল তাহারে ॥
ধনমদে মত্ত হয়ে লক্ষ্মী করি হেলা।
নানা রত্ন পূর্ণ তরী বাণিজ্যেতে গেলা।।
দৈবযােগে লক্ষ্মী কোপে সহ ধনজন।
সপ্ততরী জলমধ্যে হইল নিমগন ।
গৃহমধ্যে ধনৈশ্বর্য যা ছিল তাহার।
বজ্রাঘাতে দগ্ধ হয়ে হলাে ছারখার।
দূরে গেল ভ্রাতৃভাব হলাে ভিন্ন অন্ন।
সােনার সংসারে তার সকলে বিপন্ন।
ভিক্ষাজীবী হায়ে সবে ফিরে ঘরে ঘরে।
পেটের জ্বালায় ঘােরে দেশ দেশান্তরে।
এরূপ হইল কেন বুঝিতে পারিল।।
কেঁদে কেঁদে লক্ষ্মীস্তব করিতে লাগিল৷৷
সদয়া হইল লক্ষ্মী তাহার উপরে।
পুনরায় কৃপা দৃষ্টি দেন সদাগরে ।
মনে মনে মা লক্ষ্মীরে করিয়া প্রণাম
ব্রতের সংকল্প করি আসে নিজ ধাম॥
লক্ষ্মীব্রত করে সাধু লয়ে বধুগণ।।
সাধুর সংসার হলাে পূর্বের মতন |
এইভাবে লক্ষ্মীব্রত মর্ত্যেতে প্রচার।
সদা মনে রেখাে সবে লক্ষ্মীব্রত সার।
এই ব্রত যেই নারী করে একমনে।।
লক্ষ্মীর কৃপায় সেই বাড়ে ধনে জনে ।
করযােড় করি হাত ভক্তি যুক্ত মনে।
করহ প্রণাম এবে যে থাক যেখানে।
ব্রতকথা যেবা পড়ে যেবা রাখে ঘরে ।
লক্ষ্মীর কৃপায় তার মনােবাঞ্ছা পুরে ॥
লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড় মধুময়।
প্রণাম করিয়া যাও যে যার আলয় ।
লক্ষ্মী ব্রতকথা হেথা হৈল সমাপন।
মনের আনন্দে বল লক্ষ্মীনারায়ণ।