বিছানায় শুয়ে তো পড়েছেন। ঘুম কিছুতেই আসছে না। একবার এপাশ ফিরছেন, তো আবার ওপাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা। বার কয়েক জলও খেয়ে নিলেন। তাতেও লাভ হল না। শরীরে ক্লান্তি আছে, অথচ চোখে ঘুম নেই। কারণে-অকারণে অনিদ্রার এই সমস্যা অনেকেরই রয়েছে। ‘ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি’ কেন মামা, কাকা, এমনকী সিধু জ্যাঠাকে ডাকলেও কোনও লাভ হয় না। এমন ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার পথে যেতেই পারেন। তবে তাতে দু’টি সমস্যা রয়েছে। এক তো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। অন্যটি হল, অনেক সময় ঘুমের ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় জ্বালা সহ্য করতে হয়। অনিদ্রার এই জ্বালা জুড়ানোর কিছু ঘরোয়া উপায় অবশ্য রয়েছে। সেগুলো একবার দেখে নেওয়া যাক।
ঘুম কী?
দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঘুম হচ্ছে সেই সময় যখন আমরা আমাদের চারপাশ সম্বন্ধে অবহিত থাকি না। প্রধানত দুধরনের ঘুম হয়ঃ
- রেম
সারা রাতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ আমাদের এই ঘুমে কাটে। রেম ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, আমাদের মাংসপেশি শিথিল থাকে, আমাদের চোখ এদিক থেকে ওদিকে ঘুরতে থাকে এবং আমরা স্বপ্ন দেখি।
- নন রেম
এই ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে শরীর নড়াচড়া করতে পারে। এই সময় হরমোন নি:সৃত হয় এবং দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে শরীর আবার সতেজ হয়ে ওঠে। নন রেম ঘুমের চারটি স্তর আছে।
১। ঘুমের আগের স্টেজ – মাংসপেশি শিথিল হয়, হৃদস্পন্দন কমে আসে, শরীরের তাপমাত্রা কমে।
২। হাল্কা ঘুম – এই স্টেজে সহজেই ঘুম ভেঙ্গে যায়, চারপাশ সম্বন্ধে স্বাভাবিক সচেতনতা থাকে।
৩। ‘স্লো ওয়েভ ঘুম’ – ব্লাড প্রেসার কমে, এই স্টেজে লোকে ঘুমের ঘোরে হাটে বা কথা বলে।
৪। গাঢ় ‘স্লো ওয়েভ ঘুম’ – ঘুম সহজে ভাঙতে চায় না। ভেঙ্গে গেলে চারপাশ সম্বন্ধে স্বাভাবিক সচেতনতা থাকে না।
আমরা রাতে রেম এবং ননরেম ঘুমের মধ্যে থাকি, অন্তত পাঁচবার এই স্টেজগুলি ঘুরে ঘুরে আসে। সকালের দিকে আমরা বেশি স্বপ্ন দেখি।
কী করবেন
১. প্রাণায়াম আপনাকে রিল্যাক্স করতে সাহায্য করে। তাতে যে কেবল মন ভালো হয় তা নয় কিন্তু, ধীরে ধীরে আপনার নার্ভাস সিস্টেমের স্বাস্থ্যও ভালো হতে আরম্ভ করে। ফলে অনেক শারীরিক অসুবিধে থেকেও মুক্তি পাবেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রাণায়াম করলে তা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে এবং শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। শুধু তাই নয়, এটি আপনার মনকে শান্ত করতে এবং দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে। ওহরি রাতে অনুলোম-বিলোম এবং ভ্রামরি প্রাণায়াম করার পরামর্শ দেন। তবে এক্ষেত্রে খালি পেট থাকা খুবি জরুরি । অন্যান্য প্রাণায়ামের তুলনায় এটি বেশি উপকারী।
২. যদি কোনো চিন্তা আপনার মাথায় ঘোরে এবং সে ব্যাপারে তখনি কিছু করা সম্ভব না, তাহলে সেটা লিখে রাখুন। শোবার আগে নিজেকে বলুন যে কাল আমি এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করব।
৩. যদি ঘুম না আসে, উঠে রিলাক্সিং কোনো কাজ করুন। বই পড়ুন, টিভি দেখুন অথবা হাল্কা গান চালান। খানিকক্ষণ বাদে আপনার ঘুম ঘুম লাগলে বিছানায় শুতে যান।
৪. অনেকেরই অভ্যাস থাকে ঘুমতে যাওয়ার আগে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার। যাঁদের এই অভ্যাস আছে, তাঁদের জন্য খুবই ভালো। আর যাঁদের নেই, তাঁরা এই অভ্যাস আয়ত্ব করে ফেলুন। ঈশ্বরের নাম করলে আমাদের মনে শক্তি আসে। যা আমাদের নতুন উদ্যমে কাজ করতে সাহায্য করে।
৫. আপনি যদি প্রাণায়ামের চেয়ে সহজ কিছু চান, তাহলে ওম জপের সঙ্গে গভীর শ্বাস প্রশ্বাস অনুশীলন করুন। এর জন্য আপনাকে প্রথমে ওম জপ করার সময় শ্বাস নিতে হবে এবং নাক ও মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়তে হবে। যে ওম শব্দটি মনের উপর খুব ভালো প্রভাব ফেলে যা আপনাকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করতে পারে। ওম জপ করার সময়, পরপর দুটি উচ্চারণের মধ্যে নীরবতা পালন করুন।
৬. ঘুমের সময় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, মিউজিক প্লেয়ার বিছানা থেকে শতহাত দূরে রাখুন! বেড-সাইড টেবিলে জ্বালাতে পারেন সুগন্ধি মোমবাতি ! আর শান্ত, মৃদু গান কিন্তু ঘুমের মোক্ষম ওষুধ! অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহারের কারণে আমাদের ঘুমের ধরন ব্যাহত হয়। ঘুমানোর আগে ফোন ব্যবহার করা বা টিভি দেখা আপনার মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে, যা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং সারা রাত ধরে ঘুরতে থাকে। আয়ুর্বেদ অনুসারে, রাতে ঘুমানোর আগে একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করুন। আরামদায়ক এবং শান্ত সঙ্গীত শোনা বা ভাল ঘুম পেতে একটি বই পড়া ভাল হবে। এতে করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়বেন।
কী করবেন না
১. বেশিদিন না ঘুমিয়ে কাটাবেন না। রাতে ক্লান্ত বোধ করলে তবেই শুতে যাবেন, কিন্তু সকালে একই সময়ে উঠবেন, আপনি ক্লান্ত বোধ করুন আর নাই করুন।
২. চা বা কফি পান করার পর শরীরে অনেকক্ষণ ক্যাফিনের প্রভাব থাকে। দুপুরের পর আর চা বা কফি খাবেন না। সন্ধ্যাবেলা আপনি গরম কোনো পানীয় খেতে চাইলে, হয় দুধ বা অন্য কোনো ক্যাফিনমুক্ত পানীয় পান করুন।
৩. বেশি মদ, সিগারেট খাবেন না। প্রাথমিক ভাবে ঘুম এলেও, প্রায় অবধারিতভাবে আপনার মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
৪. বেশি রাতে ভারী খাবার খাবেন না। নৈশভোজ সন্ধ্যার দিকে সারতে পারলেই ভালো।
৫. আপনার রাতে ঘুম না হলে,পরদিন দিনের বেলা ঘুমোবেন না। তাহলে ফের সেদিন রাতে ঘুম আসতে অসুবিধা হবে।
এই পন্থায় চলে, তাও যদি আপনার ঘুম না আসে, আপনার ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আপনার কী চিন্তা মাথায় ঘুরছে, রাতে ঘুম আসছে না সে বিষয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার ডাক্তার বুঝতে পারবেন আপনার অনিদ্রার কারণ কী- শারীরিক অসুখ, মানসিক অশান্তি নাকি কোন ওষুধ যা আপনি খাচ্ছেন?অনিদ্রা দীর্ঘস্থায়ী হলে, কগ্নিটিভ বিহেভিয়র থেরাপির সাহায্যে আপনি উপকার পেতে পারেন।